
স্টাফ রিপোর্টার:
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণঅধিকার পরিষদের ‘একীভূত হওয়ার আলাপ’ চললেও আপাতত তা বন্ধ হয়ে গেছে। এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টিসহ বেশ কয়েকটি মধ্যমপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তি ‘নির্বাচনী জোট’ গঠনের চিন্তা-ভাবনা করছে। এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদ যেন সেই পথেই হাঁটছে। অন্যদিকে, বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে গিয়ে নতুন এই জোট গঠনকে ‘সবচেয়ে ভালো উদ্যোগ’ হিসেবে দেখছে এনসিপি।
তবে, নির্বাচনী জোট শুধু আসন ভাগাভাগির জন্য নয়; আদর্শিক, সংস্কারপন্থী ও ন্যূনতম ঐক্যের সঙ্গে মিললেই চূড়ান্ত করবে বলে দলটির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা এখনো এই বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিইনি। এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলমান। যাচাই-বাছাই চলমান। রাজনীতিতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। শেষ সম্ভাবনাটুকুও দেখতে হয়। বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা চলছে।’
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে দলের নিবন্ধন, প্রতীক, নেতাদের বেফাঁস বক্তব্য, বিশাল গাড়িবহরসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়ে নতুন দলটি। এরই মাঝে যুক্ত ছিল গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপির একীভূত হওয়ার আলোচনা। দলীয় নিবন্ধন চূড়ান্ত হলেও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দলীয় প্রতীক ‘শাপলা’ নিয়ে চলছিল টানাপোড়েন। তবে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা কলি’ নিতে রাজি হয়েছে এনসিপি
“আমরা চাই, বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে দুই প্রধান ব্লক অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের বাইরে, তাদের জোটের বাইরে একটি তৃতীয় জোট বা ‘থার্ড ব্লক’ যদি করা যায়, এটা হবে সবচেয়ে ভালো। এটা আমাদের চেষ্টায় আছে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে।”
সারোয়ার তুষার বলেন, ‘জোটের বাইরে আমাদের যারা প্রার্থী আছেন, সম্ভাব্যরা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা কিছুদিনের মধ্যে প্রার্থীদের নামের তালিকা ঘোষণা করব। আমরা সারাদেশে আমাদের সক্ষমতাটা তৈরি করতে চাচ্ছি। মানে, আমাদের প্রার্থী যেন অন্তত সব জায়গায় থাকে। তারপর পরিস্থিতি অনুযায়ী সমঝোতা কিংবা জোট, সেটা তখন হবে।’
জানা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে দলের নিবন্ধন, প্রতীক, নেতাদের বেফাঁস বক্তব্য, বিশাল গাড়িবহরসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়ে নতুন দলটি। এরই মাঝে যুক্ত ছিল গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপির একীভূত হওয়ার আলোচনা। দলীয় নিবন্ধন চূড়ান্ত হলেও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দলীয় প্রতীক ‘শাপলা’ নিয়ে চলছিল টানাপোড়েন। তবে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা কলি’ নিতে রাজি হয়েছে এনসিপি। দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী রোববার (২ নভেম্বর ২০২৫) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক শেষে এমন ঘোষণা দেন।
আমরা চাই, বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে দুই প্রধান ব্লক অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের বাইরে, তাদের জোটের বাইরে একটি তৃতীয় জোট বা ‘থার্ড ব্লক’ যদি করা যায়, এটা হবে সবচেয়ে ভালো। এটা আমাদের চেষ্টায় আছে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে – সারোয়ার তুষার।
এনসিপির একাধিক নেতা ঢাকা পোস্টকে জানান, গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপির বেশিরভাগ নেতাকর্মীই তরুণ। কোটা সংস্কার থেকে শুরু করে বিগত জুলাই আন্দোলনেও তারা একসঙ্গে রাজপথে ছিলেন। সেই হিসেবে দুই দলের অনেক কাজেরই মিল রয়েছে। তাই তাদের উচ্চপর্যায়ে একীভূত হওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। বর্তমানে সেটি আপাতত হচ্ছে না। এখন গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপি ছাড়াও ‘মধ্যমপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তি’ নিয়ে জোট গঠনের ভাবনা চলছে। শুধু জোট নয়, এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে। নিজস্ব রাজনীতি দাঁড় করানো, সংগঠন শক্তিশালীকরণ এবং নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্তকরণের কাজটি বর্তমানে এনসিপি করছে।
দলীয় সূত্র মতে, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতৃত্বে নয়টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনী জোট গঠনের চিন্তা-ভাবনা করছে। এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), গণতন্ত্র মঞ্চের নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও জেএসডি (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) নিয়ে হতে যাচ্ছে এই জোট।
বিএনপির সঙ্গে আপনাদের আলোচনা হচ্ছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আলোচনা সবার সঙ্গেই হচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে স্পেসিফিকভাবে আসন সমঝোতা বা জোট— এসব বিষয়ে কথা হয়নি। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়, যোগাযোগ আছে। যোগাযোগ অন্যান্য দলের সঙ্গেও আছে। আমরা শুধুমাত্র আসন পাওয়ার জন্য কারও সঙ্গে জোট করব না। ন্যূনতমভাবে কিছু আদর্শিক বা নৈতিক কিছু পরিবর্তন বা সংস্কার বিষয়ক কিছু দাবি-দাওয়া মিলতে হবে। তারপর আমরা হয়তো জোট করব। মধ্যমপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তি, তাদের নিয়েও আমরা জোট গঠনের চেষ্টা করছি।’
গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতৃত্বে নয়টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনী জোট গঠনের চিন্তা-ভাবনা করছে। এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), গণতন্ত্র মঞ্চের নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও জেএসডি (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) নিয়ে হতে যাচ্ছে এই জোট
এখন পর্যন্ত কয়টা দলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন— জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক দলের সঙ্গেই কথা বলছি। যেমন- গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত দল। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।’
এদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এনসিপির নির্বাচনী জোট গঠনের বিষয়ে বেশ আলোচনা ছিল। কিন্তু সেটা আপাতত হচ্ছে না— এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। রাজশাহী বিভাগীয় প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় তিনি এই ইঙ্গিত দেন। বলেন, ‘সংস্কারের বিপক্ষে যদি কেউ দাঁড়ায় বা ইতিহাসে দায়ভার রয়েছে— এমন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এনসিপির জোট হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
জোটে যাওয়া প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত কোনো জোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিইনি। যদি সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সেটা অবশ্যই একটি নীতিগত জায়গা থেকে আসবে। যদি সংস্কারের বিপক্ষে কেউ দাঁড়ায়, বাংলাদেশে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের যে নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়— এই ধরনের কোনো শক্তির সঙ্গে বা যাদের ইতিহাসের দায়ভার রয়েছে— এমন শক্তির সঙ্গে জোটে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অনেকবার ভাবতে হবে। আমরা একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি। জনগণের অনেক প্রত্যাশা আমাদের কাছে এবং আমরাও নিজেদের স্বতন্ত্রতা নিয়ে দাঁড়াতে চাই।’
অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টির সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনী জোট বা আসন সমঝোতা নিয়ে দুই দলের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক চলছে। বিএনপির পক্ষ থেকে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এনসিপির সঙ্গে লিয়াজোঁ করছেন। এনসিপির নাহিদ ইসলাম, আখতার হোসেনসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা বিএনপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে যাচ্ছেন— এমন গুঞ্জনও রয়েছে।
জোট গঠন নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ‘এনসিপি এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইলেক্ট্ররাল অ্যালায়েন্স (নির্বাচনী জোট) করবে কি না। যদি করে অবশ্যই এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে করবে, তা হচ্ছে— যারা আগামীর বাংলাদেশে জুলাই সনদের প্রতিটি সংস্কার বাস্তবায়নে কাজ করবে, যারা বিচার নিশ্চিত করতে কাজ করবে, যারা শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তা এবং পুনর্বাসনের জন্য কাজ করবে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের স্বার্থে আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান ও ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী অবস্থান থাকলে এনসিপি তাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করতে পারে।’
বিএনপির সঙ্গে স্পেসিফিকভাবে আসন সমঝোতা বা জোট— এসব বিষয়ে কথা হয়নি। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়, যোগাযোগ আছে। যোগাযোগ অন্যান্য দলের সঙ্গেও আছে। আমরা শুধুমাত্র আসন পাওয়ার জন্য কারও সঙ্গে জোট করব না। ন্যূনতমভাবে কিছু আদর্শিক বা নৈতিক কিছু পরিবর্তন বা সংস্কার বিষয়ক কিছু দাবি-দাওয়া মিলতে হবেসারোয়ার তুষার, যুগ্ম আহ্বায়ক, এনসিপি
অন্যদিকে, এনসিপির নেতৃত্বে গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জোট করছে, এটি ‘মিথ্যা’— দাবি করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। তিনি বলেন, ‘এনসিপির পক্ষ থেকে যৌথ নেতৃত্বে জোট করার প্রস্তাব এলেও এখনো আলোচনা শেষ হয়নি। তবে, যৌথ নেতৃত্বে জোট করার প্রস্তাব এনসিপির পক্ষ থেকে এসেছে। কিন্তু আমরা বলেছি, আরও আলোচনা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, “এনসিপির সঙ্গে একীভূত হওয়ার আলোচনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর দলটির কিছু নেতার বক্তব্য ছিল ‘অশোভন, অপরিপক্ব ও অরাজনৈতিক’। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক জোট নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। কিছু করতে গেলে উদারতা, আন্তরিকতা প্রয়োজন। আমরা বলেছি, আগে সবার মধ্যে সেই উদারতা ও পরিপক্বতা পরিলক্ষিত হোক, তারপর নির্বাচনী জোটের আলোচনা করা যাবে। রাজনীতি কোনো পুতুল বিয়ে দেওয়ার খেলা নয়, বিয়ে দিলাম আর ভেঙে গেল।”
দলীয় সূত্র থেকে আরও জানা যায়, জোট গঠন নিয়ে এনসিপিতেও দুই ধরনের মত আছে। কেউ কেউ চান এককভাবে নির্বাচন করে নিজেদের সক্ষমতা যাচাই করতে। আবার নির্বাচনে যদি বেশি সংখ্যক আসন ছাড় দেওয়া হয় তাহলে জোটে যেতে আগ্রহী অনেকে। এনসিপি নয়টি দলের সঙ্গে জোটের আলোচনা করলেও বিএনপির সঙ্গে লিয়াজোঁ রাখার বিষয়টিও সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জোট নিয়ে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমাদের মূল ফোকাসটা হচ্ছে সংস্কার। আমরা এমন কোনো দলের সঙ্গে জোট করব না, যে দল সংস্কারবিরোধী হবে, যে দল শেষ পর্যন্ত সংস্কার মেনে নেবে না। দেশের সংস্কার চায়, নতুন শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন একটা বাংলাদেশ গড়তে চায়— সেসব দলের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হতে পারে।’
এখন পর্যন্ত কোনো দলের সঙ্গে আপনাদের আলোচনা হয়েছে কি না— জবাবে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক আলোচনা বিভিন্ন দলের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে হয়। জোট সংক্রান্ত আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত বা কোনো কিছুই এখনো হয়নি।’
























