বাংলাদেশ, বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর ২০২৫ ইং , ২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ রাত ১:৫৭

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে অকার্যকর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ২ কোটি টাকা গায়েব! অভিযোগের তীর দুই প্রকৌশলীর দিকে


প্রকাশের সময় :২৪ অক্টোবর, ২০২৫ ২:৪০ : অপরাহ্ণ

এম.এইচ মুরাদ:

বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সরকারি হাসপাতাল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরই চিকিৎসাসেবা নিতে বেশি ভিড় জমে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে। প্রায় ৫ হাজার লোকের আনাগোনা থাকে এই হাসপাতালে। সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর এই হাসপাতালের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এসেছে। এরপর খোঁজখবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা (ফায়ার ডিটেকশন ও অ্যালার্ম সিস্টেম) অকার্যকর। এই অকার্যকর ব্যবস্থা বসিয়েই ২ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। এই অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মা ও শিশু হাসপাতালে মোট ১৯টি বিভাগ আছে। প্রতিদিন অন্তর্বিভাগে রোগী ভর্তি থাকে ৮০০ থেকে ৮৫০ জন। প্রতিদিন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে ১৮০০ থেকে ২০০০ জন। একইভাবে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেয় ২০০ থেকে ২৫০ রোগী। অ্যাকুইট মেডিসিন ইউনিটে ভর্তি থাকে ১৫-১৮ জন। আইসিইউতে ভর্তি থাকে ২৫-৩০, সিসিইউতে ২০-২৫, এনআইসিইউতে ৬০-৭০, শিশু আইসিইউতে ৪০-৪৫ এবং ক্যানসার ইনস্টিটিউটে ভর্তি থাকে ৫০-৫৫ রোগী।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে ইপিজেডের কারখানায়, ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতালের ফায়ার ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এর পর থেকে রোগী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক ভর করেছে।

সূত্র জানিয়েছে, হাসপাতালে ফায়ার ডিটেকশন ও অ্যালার্ম সিস্টেম সরবরাহে সিম্যানটেক লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ২০২৩ সালের ১ জুন কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। ২০২৪ সালে কাজটি শেষ করার কথা। কিন্তু এখনো তারা কার্যাদেশ অনুযায়ী কাজ বুঝিয়ে দিতে পারেনি। অথচ পাঁচ দফায় ২ কোটি ৫ লাখ ৫১ হাজার ৬২৮ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে হাসপাতাল থেকে। এ-সংক্রান্ত বিলের কপি প্রতিবেদকের হাতে সংরক্ষিত আছে।

অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় গলদের বিষয়টি জানিয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. নুরুল হক সিম্যানটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, ‘হাসপাতালের ফায়ার ডিটেকশন ও অ্যালার্ম সিস্টেম বর্তমানে অকার্যকর, যা আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা। ফলে অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলায় এই হাসপাতাল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। প্রাথমিক তদন্তে দুটি বিষয় দৃষ্টিগোচর হয়। এক. শিডিউলে বর্ণিত এনএফপিএ স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে কাজের চুক্তি থাকলেও তা বাস্তবে অনুসরণ করা হয়নি। দুই. শিডিউলে ইউপিভিসি পাইপ উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করা হয়েছে। চিঠিতে ‘ত্রুটিপূর্ণ কাজের জন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রতিষ্ঠানটি দায়ী থাকবে’ বলে উল্লেখ করা হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিম্যানটেকের বিজনেস ডেভেলপার মুহাম্মদ নূর ফাহাদ বলেন, ‘কার্যাদেশ মতে, অগ্নিনির্বাপণের পুরো ব্যবস্থাটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে পরবর্তীকালে কী হয়েছে, তা আমরা জানি না। কিন্তু গত এক বছর আমরা সেখানে কোনো কাজ করতে পারছি না।’ বর্তমানে মা ও শিশু হাসপাতালের কাছে তাদের ৭-৮ কোটি টাকা বকেয়া আছে বলেও জানান তিনি।

তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে ভিন্ন কথা। এ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সৈয়দ মোরশেদ হোসেন বলেন, ‘ফায়ার ব্যবস্থাপনায় গলদের বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ার পরই আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদন আসার পর পুরো চিত্রটা আমাদের সামনে আসবে। এরপর আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এ ক্ষেত্রে কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু সিস্টেমটা চালু হয়নি।’

নেপথ্যে আছে ভিন্ন ঘটনা:

এদিকে এই অগ্নিনির্বাপণ ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে পরিচালনা কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার অভিযোগ তুলেছেন সহকারী প্রকৌশলী মো. নুরুল মোস্তফা। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল মান্নান রানার বিরুদ্ধে আনা এক অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, হামলা হয় ১৬ অক্টোবর। পরদিন তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে। অভিযোগের কপি প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল মান্নান রানা বলেন, ‘হাসপাতালের কেনাকাটার বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদনে নানা অনিয়মের কথা উঠে এসেছে। সেই অনিয়ম ঢাকতেই আমার বিরুদ্ধে ঘুষি মারার এই মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। আমি একজন শিল্পী মানুষ, আমার কি কাউকে ঘুষি মারার বয়স আছে?’

অনিয়ম ও মারামারির বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশনে রেকডিং আছে বলে প্রতিবেদকদের সময় দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং নির্বাহী প্রকৌশলী নাসির উদ্দীনের সাথে কথা বলতে বলেন।

পরে নির্বাহী প্রকৌশলী নাসির উদ্দীনের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনিয়মের বিষয়টি হাসপাতাল কতৃপক্ষ অবগত হলে প্রথমে বিষয়টি হাসপাতালের পক্ষ হতে ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল মান্নান রানা স্যার তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী প্রকৌশলী নুরুল মোস্তফার কাছে বিস্তারিত জানতে চান। এবং প্রজেক্টের যন্ত্রপাতিগুলো স্টোররুমে রিসিভ করে তারপর ব্যবহার করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোন সদোত্তর দিতে পারেনি। পরে বিষয়টি খোঁজ নিলে জানা যায় স্টোরে রিসিভ না দেখিয়ে শুধুমাত্র সহকারী প্রকৌশলী নুরুল মোস্তফা ও প্রধান প্রকৌশলী অনুরুপ চৌধুরী এর সাক্ষরিত একটি ভাউচারে যন্ত্রপাতিগুলো রিসিভিং দেখানো হয়। যা পরবর্তীতে অগ্নিনির্বাপণ প্রজেক্টটিতে সংযোজনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এতে কার্যত প্রজেক্টটি অকেজো হিসেবে পড়ে আছে হাসপাতালটিতে। যেহেতু সাপ্লাইয়ার এবং তখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের বক্তব্যে অসংগতি দেখা দেয় তখন আবদুল মান্নান রানা স্যার বিষয়টি নিয়ে সহকারী প্রকৌশলী নুরুল মোস্তফাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকলে এক সময় সেটি উত্তেজনার পর্যায়ে চলে যায়। পরে সেটি ম্যানেজমেন্ট এর মধ্যস্থয়ায় সাময়িক সমাধান ও হয়। এখন অনিয়মের বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। কমিটির মেয়াদ এক সপ্তাহ নির্ধারণ করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট আসলে অনিয়মের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।’

প্রধান প্রকৌশলী অনুরুপ চৌধুরীর কাছে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এই বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি প্রতিবেদকের প্রতিটি প্রশ্নে তার দ্বায় এড়িয়ে বারবার তদন্ত রিপোর্টের উপর সবকিছু চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। তিনি প্রজেক্টের সব যন্ত্রপাতিগুলো বুঝে পেয়েছেন এবং বিল প্রদান করার ভাউচারে সাক্ষর করেছেন কিনা জানতে চাইলেও তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। অথচ তিনি প্রজেক্টের সকল যন্ত্রপাতি বুঝে পেয়েছেন মর্মে ভাউচারে সাক্ষর করে সাপ্লাইয়ারকে বিল প্রদান করতে সুপারিশ করার সকল ডকুমেন্টস হাসপাতাল কতৃপক্ষ প্রতিবেদকের সামনে উপস্থাপন করেছেন।’

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নির্বাহী কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট কতৃক প্রকৌশলীকে হেনস্তার বিষয়টি সামনে আসার পর ফায়ার ব্যবস্থাপনায় গলদ ও অনিয়মের বিষয়টি সবার সামনে বেরিয়ে আসে। এরপরই হাসপাতাল কতৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে।

ট্যাগ :