বাংলাদেশ, বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর ২০২৫ ইং , ২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ রাত ১:৫৬

তারেক রহমানের বক্তব্যের বিশ্লেষণ : প্রতিহিংসামুক্ত ন্যায়ভিত্তিক আগামীর বাংলাদেশের রূপরেখা


প্রকাশের সময় :১৩ অক্টোবর, ২০২৫ ৫:৩১ : পূর্বাহ্ণ

রয়েল কুমার পাল:

বাংলাদেশের ইতিহাসে বোধহয় এ-ই প্রথম, কোনো রাজনৈতিক দলীয় প্রধানের (যদি আগামীর প্রধানমন্ত্রী হন) বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের সামান্যও অবকাশ নেই। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি জীবনে বহু নেতার রাজনৈতিক ভাষণ বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতি শুনেছি, কিন্তু এমন ভারসাম্যপূর্ণ, পরিমিত ও বাস্তবভিত্তিক বক্তব্য বিরল। দীর্ঘ ১৭ বছর পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বিবিসি সাক্ষাৎকার সেই বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।

তাঁর বক্তব্যের প্রতিটি বাক্যে যে সতর্কতা, দায়িত্ববোধ ও নীতিনিষ্ঠতা প্রকাশ পেয়েছে, তা স্পষ্ট করে দেয় তিনি আর কেবল রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নন; বরং এক পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রদৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই জনগণের সামনে হাজির হয়েছেন।

বাস্তবতার নিরিখে আগামীর বাংলাদেশের রূপরেখাঃ

বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান যে দিকগুলো তুলে ধরেছেন, তা কেবল রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং একটি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন। তিনি জানিয়েছেন দেশের জনগণ যদি বিএনপিকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেন, তবে সরকার হবে প্রতিহিংসামুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক।

তিনি অতীতের অনেকের মতো “দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স” বলে জনগণের অর্থ লুটপাটের প্রতিশ্রুতি দেননি, বরং জনগণের প্রয়োজন, বাস্তবতা ও সামর্থ্যের নিরিখে করণীয় নির্ধারণের কথা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে নির্বাচন হতে হবে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার উৎসব, কোনো প্রহসন নয়।

রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও নেতৃত্বের দর্শনঃ

সাক্ষাৎকারে তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন বিএনপির নেতৃত্ব হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, পারিবারিক উত্তরাধিকার নয়।
এ কথায় প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর গণতান্ত্রিক সংস্কারের মানসিকতা, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে রাজনীতিকে আরও অংশগ্রহণমূলক ও আধুনিক করে তুলবে।

তাঁর বক্তব্যে একধরনের রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও ধৈর্য স্পষ্ট। তিনি প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে নয়, বরং যুক্তি, উদাহরণ ও বাস্তবতার মাধ্যমে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। এর ফলে তাঁর বক্তব্য শুধু দলের কর্মীদের নয়, নিরপেক্ষ জনগণের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে তাঁর দৃঢ়তাঃ

বিবিসি সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান তাঁর পরিবারের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও নিপীড়নের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা নিয়েও কথা বলেছেন।
তিনি উল্লেখ করেন তাঁর মা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বারবার মিথ্যা মামলা, রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও মানসিক শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি অমানবিক কারাবাসেরও শিকার হয়েছেন, তার ভাই মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁর নিজের বিরুদ্ধেও অসংখ্য মামলার জাল পাতা হয়েছিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার জন্য।

কিন্তু এই নির্যাতন তাঁকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করেনি, বরং আরও দৃঢ় করেছে তাঁর ন্যায়ভিত্তিক রাজনীতির বিশ্বাস। তিনি প্রতিহিংসা নয়, ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সত্য উদ্ভাসিত হোক এই নীতিতেই অটল থেকেছেন।

এই জায়গাটিই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। যিনি ব্যক্তিগত কষ্টের মধ্য দিয়েও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী থাকতে পারেন, তিনি কেবল রাজনীতিবিদ নন একজন দায়িত্বশীল রাষ্ট্রনায়ক।

তাঁর এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নিয়েছে প্রতিহিংসামুক্ত রাষ্ট্রচিন্তা যেখানে বিচার হবে, কিন্তু প্রতিশোধ নয়; ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে, কিন্তু কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়।

আইন, বিচার ও প্রতিহিংসামুক্ত শাসনের প্রতিশ্রুতিঃ

তারেক রহমান বলেছেন দেশে যেসব গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা বা রাজনৈতিক নিপীড়ন ঘটেছে, সব ঘটনার বিচার হবে। তবে সেটি হবে দেশের প্রচলিত আইন ও আদালতের কাঠামোর মধ্যেই, প্রতিহিংসা নয়, আইনের শাসনের মাধ্যমে।

এই বক্তব্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক গভীর বার্তা রাষ্ট্রক্ষমতা হবে ন্যায় ও নীতির অধীন, কোনো দলের প্রতিশোধের উপকরণ নয়। তিনি এটিও স্পষ্ট করেছেন মিথ্যা বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের হওয়া মামলাগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় পুনর্বিবেচনা করা হবে, তবে আদালতের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা অক্ষুণ্ণ রেখেই।

এর মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক প্রতিশোধের চক্র থেকে বেরিয়ে এসে একটি আইননিষ্ঠ, মানবিক ও স্থিতিশীল বিচারব্যবস্থা গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন।

সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের লক্ষ্য উন্নয়ন ও ন্যায়বিচারঃ

তারেক রহমানের বক্তব্যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নচিত্রও উঠে এসেছে। তিনি বিশ্বাস করেন দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও দলীয়করণের অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রকে এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে প্রশাসন ও অর্থনীতি জনগণের সেবক হয়, প্রভু নয়।

তাঁর ভাবনায় আছে নৈতিকতার পুনর্জাগরণ, মানবিক রাষ্ট্র গঠন, এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
তিনি মনে করেন উন্নয়ন তখনই টেকসই হবে, যখন তা ন্যায়বিচার ও মানবিকতার ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে।

বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও আশার সেতুবন্ধনঃ

তারেক রহমানের বক্তব্য নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
তাঁর পরিকল্পনা যদি সত্যিকার অর্থেই বাস্তবায়িত হয়, তবে প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ হবে, বিচারব্যবস্থা হবে স্বাধীন ও ন্যায়ভিত্তিক, জনগণ ফিরে পাবে রাজনীতির প্রতি আস্থা, আর বাংলাদেশ পাবে এক নতুন সূচনা যেখানে উন্নয়ন ও ন্যায় এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাত মেলাবে।

কিন্তু আমরা তো ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই কারণ আমাদের অতীত সুখকর নয়। তাই শত আশ্বাসেও প্রশ্ন তো থেকেই যায়, এটি কি কেবল বক্তব্যের পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বাস্তবে রূপ নেবে?
এই কঠিন বাস্তব প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সময়ের বিচারালয়ে।

তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় তারেক রহমানের বক্তব্যে যে প্রজ্ঞা, সংযম ও দূরদর্শিতা প্রতিফলিত হয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে এবং আপামর সাধারণ মানুষকে নতুন আশায় উজ্জীবিত করেছে।

আমি আশা রাখি, দেশের মানুষ আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্যে আশান্বিত হয়ে আরেকবার দেশ পরিচালনার সুযোগ দেবেন।

তাই তারেক রহমানের বিবিসি সাক্ষাৎকার কেবল একটি রাজনৈতিক বক্তব্য নয় এটি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক মনস্তাত্ত্বিক মোড় পরিবর্তনের ঘোষণা। এই বক্তব্যে ফুটে উঠেছে এক নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় যিনি প্রতিশোধ নয়, ন্যায়কে, ক্ষমতা নয়, সেবাকে এবং ভয় নয়, আশাকে বেছে নিয়েছেন।

লেখক:

রয়েল কুমার পাল
গণমাধ্যম কর্মী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।

ট্যাগ :