বাংলাদেশ, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫ ইং , ১২ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ রাত ১২:২০

শিরোনাম

ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের লুটপাট! ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে জামানত মাত্র ৫৫৬ কোটি


প্রকাশের সময় :২৪ মে, ২০২৫ ১১:০৩ : অপরাহ্ণ

স্টাফ রিপোর্টার:

ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ করপোরেট শাখা থেকে বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ নিয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ। অথচ এই বিপুল অঙ্কের ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের হাতে জামানত রয়েছে মাত্র ৫৫৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকার। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে কার্যত কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এই ঋণ বিতরণ হয়েছে। শাখাটির কার্যক্রম ব্যাংকিংয়ের নিয়মকানুনের সম্পূর্ণ বাইরে চলে গিয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিদর্শন ও অডিট প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত এস আলম গ্রুপ ও তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর নামে বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ঋণ দেওয়া হয়েছে কোনো বাস্তব ভিত্তি, উপযুক্ত জামানত কিংবা পর্যাপ্ত কাগজপত্র ছাড়াই। এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের হাতে সহায়ক জামানত আছে মাত্র ৫৫৬ কোটি টাকা। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, এমন ঋণের বিপরীতে পূর্ণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়, যা ব্যাংকের মোট মুনাফা দিয়ে কভার করাও প্রায় অসম্ভব।

অডিটে আরও বলা হয়েছে, খাতুনগঞ্জ শাখায় গত কয়েক বছর কার্যত কোনো ব্যাংকিং হয়নি। কিছু কর্মকর্তা ব্যাংকিংয়ের নিয়ম ভেঙে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং এস আলম গ্রুপের সঙ্গে যোগসাজশে বিপুল অর্থ আত্মসাতে জড়িত ছিলেন। এস আলম গ্রুপের অন্তত ১৭টি কোম্পানির নামে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে। গ্রুপটির কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন, কর্মকর্তাদের নামেও এসব ঋণ তোলা হয়েছে। অনেক ঋণ নেওয়া হয়েছে ভুয়া দলিলপত্র দেখিয়ে। এমনকি কিছু সম্পত্তি এখনো ইসলামী ব্যাংকের নামে নামজারিও হয়নি, ফলে আইনি সুরক্ষা তো দূরের কথা, বন্ধক রাখা বা বিক্রিরও সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, কেবল খাতুনগঞ্জ শাখায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটি দেখিয়েছে মাত্র ৩২ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। এই ঋণের বিপরীতে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। পুরো ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৬৯ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। এতে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং আমানতকারীদের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। ২০২৪ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এই হারে চললে কেবল এস আলম গ্রুপের ঋণ কাভার করতে ব্যাংকটির সময় লাগবে অন্তত ১৩ বছর। মুনাফা কমলে এই সময় আরও বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন টিমের এক কর্মকর্তা বলেন, ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির কাছে এস আলম গ্রুপের ১১ হাজার শতক জমি, ১৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস, স্থাপনা, মেশিনারিজ, নগদ ও এফডিআর মিলে মোট ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সহায়ক জামানত রয়েছে। 
এরমধ্যে এমনও সম্পত্তি রয়েছে যা এখনো এস আলমের নামে নামজারিও হয়নি কিংবা ইসলামী ব্যাংকের অনুকূলে আইজিপিএ (ইরিভোকেবল জেনারেল পাওয়ার অব এটর্নি) ও সম্পাদন হয়নি। নামজারি না হওয়া সম্পত্তি ব্যাংকের পক্ষে বিক্রি তো দূরের কথা বন্ধকও রাখার সুযোগ নেই। ফলে ঋণের টাকার প্রায় পুরোটাই ব্যাংকটিকে তাদের মুনাফা থেকে প্রভিশন করেতে হবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ইসলামী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা ছিল যেন এস আলমের মানিব্যাগ। যখনই কোনো নগদ অর্থের প্রয়োজন হত তখনই ইসলামী ব্যাংকে বলার সাথে সাথে টাকা পৌঁছে যেত গ্রুপটির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে। ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্য়ন্ত এক বছরে কোনও কাগজপত্র ছাড়াই শাখাটি থেকে ১৭ কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনৈতিক প্রভাব খাঠিয়ে শাখার সাসপেন্স (স্থগিত হিসাব) হতে এই টাকা উঠিয়ে বিজনেস ডেভেলপমেন্ট খরচের নামে আত্মসাৎ করেছে সংশ্লিষ্টরা। গ্রুপটির কর্ণধার সাইফুল আলমের পিএস ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন ডিএমডি আকিজ উদ্দিন ও মিফতাহ উদ্দিনের নির্দেশে এই অর্থ আত্মসাৎ হয়। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিটে এসব তথ্য উঠে আসার পর গত ১৮ মে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলা করেছে শাখাটি। 

ইসলামী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক জামাল উদ্দিন বলেন, ইসলামী ব্যাংক জনগণের আস্থার প্রতীক। আমরা ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষায় আইনি প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। গত ৭-৮ বছরে যে ক্ষতি হয়েছে তা ছিল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের তত্ত্বাবধানে সুপরিকল্পিতভাবে ইসলামী ব্যাংকিং ধ্বংস করার চক্রান্ত। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও পলিসি সাপোর্টের মাধ্যমে জনগণের আস্থা সুপ্রতিষ্ঠ করতে হবে। ব্যাংকের বর্তমান ম্যানেজমেন্টের নেতৃত্বে আমরা অত্যন্ত সযত্নে ব্যাংকের পাওনা আদায়ে সম্ভাব্য সকল আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন মেনে খেলাপি আদায়ে আমরা শেষ পর্যন্ত যাব।

ট্যাগ :